মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সংস্কৃতি তৈরি করে দেয় বিদ্যমান সমাজ, আইন, ধর্ম ও রাষ্ট্র। সঙ্গত কারণে সামাজিক আর বৈধ হৃদ্যতা দেশের প্রচলিত ধারার অনুষঙ্গ। এর ব্যত্যয় ঘটলে হানাহানি, সহিংসতা এবং বর্বরতার চিত্র দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। গতানুগতিক সমাজ ব্যবস্থায় ভালবাসার বাধনগুলোও হয় নীতি-নৈতিকতার অনন্য যোগসাজশ। সামাজিক প্রতিষ্ঠান পরিবারের নিয়মানুগ গ্রন্থিতা বাইরের কেউ ভাঙ্গতে গেলে তার দামও দিতে হয় শোচনীয়ভাবে। বৈবাহিক সম্পর্কের যে বৈধ দাম্পত্য জীবন তা সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাই পারিবারিক নির্যাতন দিনের পর দিন সহ্য করেও সংসার ভাঙ্গার কথা কেউ ভাবতে পারে না। তবে নির্মল দাম্পত্য জীবন সব সময় নিরবচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়েও যায় না। ফলে পারিবারিক নির্মল বাধনটি আলগা হতেও সময় লাগে না। তেমন টানাপোড়েনের দুঃসময়ে অন্য কেউ এসে মমতার হাত বাড়ালে উল্টো দিকের নিপীড়িত মানুষটি সহজেই সাড়া দিয়ে নতুন এক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ন্যায়-অন্যায় বোধ, ভাল-মন্দের ফারাক তখন কোনটাই কাজে লাগে না। বৈধ-অবৈধের চিন্তাও মাথায় আসে না। আর রক্ষণশীল সমাজের কিছু মানুষ তেমন সম্পর্ক নিয়ে যে মাত্রায় টানা হেঁচড়া করে তেমন অশোভন দৃশ্যও চারপাশের পরিবেশকে ম্লান এবং দৃষ্টিকটু করে তোলে। তেমনই এক ন্যক্কারজনক দুঃসহ ঘটনা ঘটেছে ঝিনাইদহে। সেখানে এক বিবাহিত দম্পতির সম্পর্কের মাঝে অন্য পুরুষের অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রচলিত মূল্যবোধে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এই অবৈধ সম্পর্কের জের হিসেবে দু’জনেরই মাথার চুল আর ভ্রু কেটে দেয়া ছাড়াও মুখে চুনকালি মেখে দেয়া হয় গ্রামীণ সালিশী বৈঠকের পরামর্শে। শুধু তাই নয়, গলায় জুতার মালা পড়িয়ে গ্রামছাড়া করা হয়। মধ্যযুগীয় এমন বর্বরতায় লাঞ্ছিত মেয়েটির বাবা পাল্টা অভিযোগও করেন। তিনি পুলিশকে জানান, প্রায় এক যুগ আগে তার মেয়ের সঙ্গে আবাইপুর গ্রামের নাসিম শেখের বিয়ে হয়। তাদের সাত বছরের একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। নির্যাতিত মেয়েটির পিতা বলেন- তাদের ১২ বছরের বিবাহিত জীবন কখনও সুখের ছিল না। সাংসারিক কলহের জেরের মাঝপথে ঘটে পরকীয়ার ঘটনা। এর জের ধরে পাড়া-প্রতিবেশী ও মাতব্বরদের নিয়ে হয় সালিশী বৈঠক। বৈঠকের সিদ্ধান্তে দু’জনকেই দেয়া হয় মধ্যযুগীয় শাস্তি, নির্যাতিত মেয়েটির বাবা মামলা দায়ের করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়। ছয়জনকে আসামি করে যে মামলা করা হয় তাতে পুলিশ ৫ জনকে আটক করে। একজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীও দিয়েছে পুলিশের কাছে। শাস্তি প্রদানের দায়িত্ব দেয়া হয় স্বামী নাসিম শেখের ওপর। চূড়ান্ত অমানবিক ভুল-ভ্রান্তি আর ত্রুটিবিচ্যুতির আলোকে আরও মানিবকভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যেত। মধ্যযুগীয় বর্বরতা আর অসম্মানে জর্জরিত না করলেও কোন ক্ষতি ছিল না। এখানে শুধু যে মেয়েটিই নির্যাতিত হয়েছে তা নয়, পুরুষটিও বিন্দুমাত্র ছাড় পায়নি। এমন অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী। সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারও নেই।
Leave a Reply